Rose Good Luck পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-৩২) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ১০:৪৬:১৬ রাত

গ্রামের বাড়িতে দু’দিন থাকার পরে বাবার সাথে খুলনায় আমাদের ব্যস্ত জীবনে ফিরে এলাম। শহরের কাছে-দূরের জীবনে অভ্যস্ত এই আমি সবসময় ভাবতাম আমার শেকড় যেখানে গ্রন্থিত, ভালোলাগাগুলো বুঝি সেখানে গেলেই আমার উপরে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে!

কিন্তু ওখানেও যে অশান্তির বীজ অনেক আগে থেকেই ভালোলাগাগুলোকে ঘৃণার অনলে দগ্ধ করে চলেছিল, অবাক হয়ে তাও অনুধাবন করে এলাম।

আমার জীবন এক মহা শূন্যতায় আবদ্ধ হয়ে গেল। কষ্টের তীব্রতায় আমি ধীরে ধীরে গলে যেতে লাগলাম... নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকলাম।

আমার আর কোনো আনন্দের জায়গাই রইলো না।

সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। আবার পড়ার টেবিলে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যে জালে জড়িয়েছিলাম তাতে একজন সাধারণ ছাত্রের মত নিরবচ্ছিন্ন ছাত্রজীবন আমি চাইলেও পাওয়াটা ঐ মুহুর্তে সম্ভব ছিল না। আমার রাজনৈতিক জীবন আমার গোপন দলটির লেবাস ছিল। আমি সরকারি ছাত্র সংগঠনের সাদা চাদর জড়িয়ে নিষিদ্ধ দলটির কালো পোশাকে আবৃত একজন সাদা মনের মানুষ ছিলাম!

মিথিলা বাবু!

এই কথাটি তোমার বুঝতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে, তাই না? আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমরা কিছু যুবক ছিলাম যাদের এই দলটিতে যোগ দেবার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। দেশের জন্য কিছু করে দেখানো। একটা শুদ্ধতার ঢেউ সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সমাজ জীবনে চলমান লাগামহীণ শোষণ-শাসনের বৈরী পরিবেশকে একটি ধাক্কা দেবার অভিপ্রায় ছিল হৃদয় মাঝে। যদিও জানতাম এই ঢেউ বিশাল দীঘির এক প্রান্ত থেকে সামান্য ঝরা পাতা পড়ে যে কম্পন সৃষ্টি করে, আমাদের ইচ্ছের ভিতরের সুপ্ত জাগরণ তার থেকেও হাল্কা ঢেউয়ের সৃষ্টি করবে।

কিন্তু প্রয়োজন ছিল এই সামান্য ঢেউয়েরই। যা ধীরে ধীরে অসামান্য হয়ে উঠবে এই বিশ্বাসে বলীয়ান ছিলাম।

একদিন বাবা আর মা এলেন হোষ্টেলে। অনেকক্ষণ রইলেন। গেস্ট রুমে বসে আমাকে পরীক্ষার ব্যাপারে দীর্ঘক্ষণ বোঝালেন। যা-ই করি না কেন, অনার্স পরীক্ষাটা ভালভাবে যেন দেই বললেন। মায়ের উৎকন্ঠিত মুখ, বাবার হাসিমুখের আড়ালে বেদনাক্লিষ্ট অবয়ব- এসবই আমাকে তাড়িত করল। আমি তাদেরকে বললাম, ‘হ্যা, তোমরা চিন্তা করনা। পরীক্ষাটা ভালভাবেই দেব।‘

আসলে কথাগুলো ওনাদেরকে বললেও আমি নিজেকেই শোনালাম আসলে। সেইভাবেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। পেছনে পড়ে রইলো মনির, চাচারা এবং নুরু খলীফা পরিবারের ওত পেতে থাকা হিংস্র কিছু মুখ। সামনে রইলো বাবা-মা এবং তাদের কিছু আকাংখা। সাময়িক সময়ের জন্য নিজেকে বিস্মৃত হতে চাইলাম। মনযোগের সকল কেন্দ্র বিন্দু পরীক্ষার দিকে রইলো। সাদেক ভাইকে সব বললাম। তিনি এই ক’দিন আমাকে পার্টির সকল কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকতে বললেন। এই কথায় নির্ভরতা পেলাম। আশ্বাস পেলাম- মনের জোর বাড়ল। তবে নিজেকে একটি তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরের মাঝে আবিষ্কার করলাম যার দুই পাড়ে দুই ভিন্ন শিবিরের কিছু চরিত্র। অসহায় আমি স্রোতের প্রতিকূলে চলছি। আর আমাকে চলায় সাহায্য করতে পারত কেবলি একজন।

তিনি তোমার মা ছিলেন মিথিলা বাবু !

লাভলিকে পেতাম পড়ার টেবিলে... বইয়ের পাতায়...অ্যালার্ম ঘড়ির ক্রমাগত শব্দের অনুরণনে... ফ্যানের বাতাসে কম্পমান ক্যালেন্ডারের পাতাগুলোয়! কোথায় সে ছিল না। চিন্তা-চেতনায় ওকে সাথে নিয়েই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

গ্রামের খবর আর কিছুদিন পেলাম না। তবে খবর ঠিকই তৈরী হচ্ছিল। আমাদের শহরের পারিবারিক শত্রু আমার গোপন দলের বিরোধী দলকে সাথে নিয়ে যে সুদূরপ্রসারী জাল বিস্তার করে চলেছিল, সেটা ঘুণাক্ষরেও কি টের পেয়েছিলাম? আর গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলেরা মনিরকে কেন্দ্র করে এক অস্থিরতায় ভুগছিল। যদিও মিমাংসা হয়ে গেছিলো। তারপরও চেয়ারম্যানের বড় ছেলে তার অন্ধ হয়ে যাওয়া সন্তানকে যতবার চোখের সামনে দেখে, আপাদমস্তক হিংস্রতায় আগুন হয়ে উঠে। সেই সময়টায় পারলে সে মনিরের রক্তপান করতেও পিছপা হতো না।

আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। ওদিকে গ্রামে ধানকাটার পরে আরম্ভ হল মেলা। বেশ বিখ্যাত ছিল এই মেলা। আশেপাশের কয়েক গ্রাম থেকে মানুষজন আসে। মৌসুমি ব্যবসায়িরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। বেশ কিছু মুনাফা হয় তিনদিন ব্যাপী চলা এই মেলায়। জুয়া চলে চরকির নামে এবং ঘোড়দৌড় এ টাকা বাজী ধরার ভিতরে। এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের হওয়াতে প্রতিবছর এই জুয়ার কোট চেয়ারম্যানের ছেলেরা বসায়। এবারও ওরা পেল।

মেলার দ্বিতীয় দিনে মনিরের সাথে আবারো সংঘাত। এটি ছিল অনেকটা পরিকল্পনা মাফিক। সাজানো একটি ছকের ভিতরে মনিরকে টেনে আনা হয়েছিল। ওর স্বভাব ছিল রগচটা। সেটা সবাই জানত। কোনোভাবে একটু রাগিয়ে দিলেই চলতো। এরপর প্রতিপক্ষের জন্য অসম্ভব সব সুবিধে মনির নিজেই পাইয়ে দিত। নিজেদের লোকজন সহ মনির জুয়ার কোটে গেল। ওখানে পছন্দ মত নাম্বারে টাকা ফেলল। প্রথমদিকে ওকে জিতিয়ে দেয়া হল। বেশ বড় অংকের টাকা মনির জিতে নিল।

মিথিলা বাবু!

ভাবছ কিভাবে জুয়ায় প্রতিপক্ষকে জিতিয়ে দেয়া যায়? হ্যা! এটা একধরণের ট্রিক্স। সোজা কথায় বিজ্ঞানের অপব্যবহার। জুয়ার বোর্ডে যে কাঁটাটি অনেকগুলো নাম্বারকে কেন্দ্র করে ঘোরে, সেটিকে নির্দিষ্ট কোনো পছন্দসই নাম্বারে থামানোর জন্য একটি চুম্বক ব্যবহার করা হয়। যা বোর্ডের একেবারে গোপন একটি যায়গায় পরিচালনাকারীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এভাবেই মনিরকে প্রথমে জিতিয়ে দিয়ে ওর ভিতরে টাকার নেশাটা জাগিয়ে দেয়া হল। এরপর শুরু হল ক্রমাগত নিম্নপতন। যা জিতেছিল সব তো নিয়েই নিল। এরপর ওর কাছে যা ছিল, সাথের ছেলেদের কাছে যা ছিল সেগুলোকেও মনির কিছুটা জেদের বশে, কিছুটা চেয়ারম্যানের বড় ছেলের টিটকারিসুলভ কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে ধার নিয়ে খেলে খুইয়ে দিলো।

জুয়ায় লাগানোর মত আর টাকা মনির এবং সাথের কারো কাছে ছিল না।

রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। রাতের আঁধারে জুয়ার বোর্ড বসে। হেরে রিক্ত অনুভূতি নিয়ে মনির ফিরে আসছিল। এমন সময় চেয়ারম্যানের বড় ছেলের কথা পরিবেশটিকে কেমন এক অশুভ করে তুলল-

‘ কিরে তোর ফুডানি সব শ্যাষ? এইডা আমাগো মতন বড় মাইনষের খেলা। তোর মত ফহিন্নির পুতের না।‘

যেন বিছুটি পাতার ঘষা খেয়েছে হৃদয়ে এমন জ্বলুনি অনুভব করল মনির। ওর ভিতরের সুপ্ত বাঘ জেগে উঠল। আজকের পরাজয়...সেদিনের সালিশে সকলের সামনে চরম অপমান...ওর বাবার গলায় একটা লাল গামছা এবং সেটাকে ধরে হিঁচড়ে টেনে নেয়া কালো হৃদয়ের একজনের দুটি হাত- সবকিছুকে ছাপিয়ে এইমাত্র বলা কথাগুলো হ্যাজাক লাইটের আলোয় মনিরের চোখ দিয়ে সহস্র সুর্যের আলোকরশ্মিকে সাথে নিয়ে কথার মালিককে ভস্মীভূত করে ফেলতে চায়। কিন্তু একটা ফাঁদের ভিতরে থেকে জীবনের চরম ভুলটা মনির করে ফেলে। হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় ওর। অকথ্য একটি গালি দিয়ে চেয়ারম্যানের বড় ছেলে যার নাম বাসেত, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এটাই ছিল মনিরের ঐ রাতে শেষ কিছু একটা করা যার অপেক্ষায় ওরা ছিল। বাসেতের ওপর হামলে পড়তেই আধার ফুঁড়ে জনা বিশেক কঠোর চেহারার যুবক মুহুর্তে মনির এবং ওর সাথের চারজনকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। মুহুর্মুহু কিল-ঘুসি লাথি আর চড় দিয়ে মনিরের সাথের চারজনকে রেহাই দেয়া হলেও মনিরকে ছাড়া হয় না। ঐ চারজন কয়েকবার মনিরকে বাঁচাতে আগালেও আক্রমনকারীদের সাথে থাকা ধারালো অস্ত্র হ্যাজাক লাইটের আলোয় ভয়ংকর রূপ দেখালে ওরা পিছিয়ে যায়। সাহায্যের জন্য নিজেদের বাড়ির দিকে দ্রুত চলে যায় ওরা। মনিরকে একেবারে নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত মাটিতে ফেলে নির্দয়ভাবে মারা হয়। সব শেষে বাসেত একটা ক্ষুর হাতে নেয়। এক পৈশাচিক উল্লাসে সে মনিরের বাম চোখের উপর থেকে এক পোঁচে মুখের একটা অংশ সহ গলা পর্যন্ত গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ফিনকি দিয়ে বের হওয়া লাল রক্তের তীব্রতা রক্তের স্বাদ পাওয়া এক বাঘে রুপান্তরিত হয়ে যায় সে। ফিরতি পোঁচটা মনিরের কন্ঠনালী লক্ষ্য করে দিতে উদ্যত সে হয়েই ছিল। কিন্তু সাথের কয়েকজন ওকে নিবৃত করে।

ওরা মনিরকে ওভাবে রক্তাক্ত প্রচন্ড ব্যথায় তড়পানো অবস্থায় ফেলে চলে যায়।

মিথিলা বাবু!

আমি এসব ঘটনার ডিটেইলস মনিরের মুখেই শিনেছিলাম। কিন্তু সে তখন আমার চাচাতো ভাইয়ের ভিতরে অন্য কেউ ছিল। একজন ভিন্ন মানুষ। সে কথায় পরে আসছি।

আমাদের বাড়ির অন্যরা সব জানতে পেরে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুঁতে আসে। মনিরকে সত্বর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকের হস্তক্ষেপে প্রাথমিকভাবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে করে।

একটা চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। বাম গালে ভ্ররুর উপর থেকে চিবুকের প্রান্তসীমা পর্যন্ত এক রুপালী দাগ মনিরের চেহারাটিকে ভয়ংকর করে তোলে। বাম চোখের শূন্য গহবরটিকে পাথরের নকল চোখ দিয়ে ঢেকে রাখার কথা বলা হলেও মনির রাজী হয় না। ওর দু’চোখের সকল আগুন একচোখে এসে ঠান্ডা হয়ে জ্বলতে থাকে।

আমাকে পরীক্ষার জন্য কিছুই জানানো হয় না। আমি জানলাম একেবারে শেষ পরীক্ষা দিয়ে আমার বাসায় আসার পর। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকেই একদিন মনির হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওর সন্ধান পাওয়া যায় না। তারপরের দিনই আমার পরীক্ষা শেষ হয়। আমি বাসায় এসে সবকিছু জানি।

আমার কোনো অনুভূতি হচ্ছিল না। আমি না পারছিলাম রাগে দিশেহারা হতে। না কেঁদে নিজেকে হাল্কা করতে। কেমন এক বোবা অনুভূতিতে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইলাম।

ভাবছিলাম মনির কোথায় যেতে পারে।

মিথিলা বাবু!

ডুমুরিয়া এবং এর আশেপাশের কয়েকটি এলাকা জুড়ে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যানারে ‘ম’ আদ্যাক্ষরের যে মানুষটি তান্ডব চালিয়ে আতংকের জনপদ বানিয়ে রেখেছিল, সে ছিল আমাদের গোপন দলের বিরোধী। লাভলিকে কেন্দ্র করে খুলনায় আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধ শক্তি সৈয়দ পরিবারের সাথে হাত মিলিয়ে ছিল এই ক্ষমতাধর মানুষটি। আমাদের দলের তাত্ত্বিকদের সাথে তার বনিবনা না হওয়াতে সে একসময় দলত্যাগ করে তার এখনকার দলটি বানিয়েছিল। সেদিক থেকে আমিও ছিলাম ওর ‘শ্রেণীশত্রু’!

বাহ! কি চমৎকার মনোভাব! শ্রেণীশত্রু ধ্বংসের নামে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে এরা বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে সম্পুর্ণ ভিন্ন পরিবেশ প্রথা এবং সংষ্কৃতিতে আবদ্ধ বিজাতীয় কয়েকটি দেশের প্রচলিত সমাজতন্ত্রকে আমাদের দেশে ইমপ্লিমেন্ট করার নামে আসলে একটি সম্পুর্ণ ভুল পথেই চলেছিল তারা। ভুল এজন্যই বলব, রাশিয়া বা চীনের জন্য যে পদ্ধতি কাজ করবে, আমাদের জন্য ও সেটি যে করবে তার পক্ষে কোনো যুক্তি রয়েছে কি? তাই দেখতে পেয়েছি আসল পুঁজিপতিদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদার বিনিময়ে চরমপন্থি দলগুলো তাত্ত্বিকভাবে যাদেরকে শ্রেণিশত্রু বলা হয়েছে, তাদের সার্থকে বহাল রেখে খতমের রাজনীতির নামে একই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া অন্য দলের কর্মী নেতাদের গলা কাটার দ্বারা শ্রেণিশত্রু খতমের মিশনে নেমেছে!

আমি সাদেক ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। তিনি ব্যাপারটা দেখছেন বলে আমাকে নিশ্চয়তা দিলেন। কিছুটা ইঙ্গিত অবশ্য দিতে ভুললেন না। আমাদের গ্রামকে কেন্দ্র করে বিপ্লবী কম্যুনিষ্ট পার্টি অনেক আগে থেকেই নজর রেখে চলেছে। হয়তো মনিরকে ওরা প্রতিশোধের লোভ দেখিয়ে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। মনিরকে কেন্দ্র করে এলাকার যুবকদের একটা বড় অংশ ঘুরপাক খায়। তাই ওকে নিতে পারলে অন্যদেরকে সহজে নেয়া যাবে। আর চেয়ারম্যান পরিবারের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমাদের বংশ তো ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। মনিরের উপর যা হয়েছে, এরপর মনির যদি নিজেকে প্রলেতারিয়েত ভেবে ওদেরকে শোষকের ভূমিকায় দেখে একটা বিপ্লব করতে চায়, তাতে ওকে দোষ দেয়া যাবে কি?

সেই সময়ে আমি এটা বিস্মৃত হলাম যে, শুধু বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টির নজর না, যে সাদেক ভাইকে আমি আমার আদর্শ মনে করেছিলাম, সেই আমাদের পুর্ব বাংলা কম্যুনিস্ট পার্টিও কি আমাদের গ্রামকে কব্জা করায় তাদের নজরকে সরিয়ে রেখেছিল? মোটেও না। কিন্তু এটি বুঝেছিলাম আরো পরে। ততোক্ষণে দেরী যা হবার সেটা হয়েই গেছে।

মিথিলা বাবু!

আসলে পার্টি কখনো কারো নয়। পার্টি জনগনের ও নয়। শোষিতদের মুক্তির কথা বলে প্রপাগন্ডা চালালেও পার্টি তাদের পক্ষেও কাজ করে না। পার্টি কেবলই তাত্ত্বিকদের!

গ্রামকে আগে কব্জা করতে হবে। সেখানে সকল শোষণ বৈষম্য দূর করে ওখানের শ্রেণি শত্রুদের নির্মুল করে গ্রামকে সর্বাগ্রে ঘাঁটি বানাতে হবে। বিপ্লবী শ্রমিক দল বানাতে হবে। এরপর গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘেরাও করতে হবে। রক্তাক্ত এক অভ্যুত্থানের দ্বারা শহরের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে স্বপ্নের সমাজতন্ত্র কায়েম করা হবে!

এই গ্রামকে ঘাঁটি বানানোর জন্যই শহর কেন্দ্রিক দুটি চরমপন্থী দল যারা ইতোমধ্যে শহ্রকেই এক রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত করেছিল, তারা কিনা দীর্ঘদিন ধরে চোখ রেখে চলেছিল বর্ডার সংলগ্ন আমাদের সুন্দর গ্রামটির দিকে!

আমি অবাক হলাম সাদেক ভাইয়ের ইঙ্গিতপুর্ণ কথাবার্তায়। শেষ পর্যন্ত মনির যদি ঐ দলে ভিড়েই যায়, গ্রামে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। মোটকথা নিজদের ভিতরের দলাদলি যা ছিল সেটা পরিণত হবে রক্তের হোলি খেলায়। ছায়া সুনিবিড় আমাদের শান্তির নীড়টি পরিণত হবে এক মৃত নগরীতে।

আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে এই অবস্থা থেকে আমার গ্রামকে রক্ষা করি।

নিজের ভিতরে এক চরম দুঃসময় অনুভব করে করে পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটা পথের দেখা আমার খুব দ্রুত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তবে আমি যার উপর নির্ভর করেছিলাম ঐ সময়ে, পরে জেনেছিলাম ঐ পথের সম্পুর্ণ বিপরীত পথটি তিনি আমাকে ইচ্ছে করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৮৮৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

305022
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৬:২৭
কাহাফ লিখেছেন :
সমাজতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে যা ঘটছে তার চমৎকার বর্ণনা পেলাম আজকের পর্বে!
আসলেই মিথ্যে ফানুসে উড়ছে 'ওরা'!
অনেক অনকে ভাল লাগা জানালাম!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!!
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:০৯
246769
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ কাহাফ ভাই।
শুভ সকাল।
305047
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১:২৩
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:১৬
246792
মামুন লিখেছেন : অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File